মূল কথা:
- বিটকয়েনের স্রষ্টা সাতোশি নাকামোটোর প্রকৃত পরিচয় প্রযুক্তি জগতের অন্যতম বড় রহস্য।
- লেন সাসামান, নিক সজাবো, অ্যাডাম ব্যাক, হ্যাল ফিনি, পিটার টডের মতো ব্যক্তিদেরকে অনেকেই সন্দেহ করে থাকেন।
- ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের প্রতিক্রিয়া হিসাবে সাতোশি নাকামোটো বিটকয়েন তৈরি করেছিলেন, যা প্রচলিত ও নিয়ন্ত্রিত আর্থিক ব্যবস্থার বিকল্প হিসাবে কাজ করে।
- HBO তাদের ডকুমেন্টারিতে পিটার টডকে সাতোশি নাকামোটো হিসাবে উল্লেখ করেছে, তবে টড এই দাবি অস্বীকার করেছেন। (ছবি)
বিটকয়েনের স্রষ্টা সাতোশি নাকামোটোর পরিচয় প্রযুক্তি জগতের অন্যতম বড় রহস্য। বিভিন্ন ব্যক্তি, যাদের প্রত্যেকেরই একটি আকর্ষণীয় পটভূমি রয়েছে এবং অনেকেই এই রহস্যের কেন্দ্রে রয়েছেন।
ডোরিয়ান নাকামোটো, যিনি ভুলভাবে সাতোশি হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ক্রমাগত এই বিষয়ে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে গেছেন। অন্যদিকে, লেন সাসামান, একজন প্রখ্যাত সাইফারপাঙ্ক এবং ক্রিপ্টোগ্রাফার, যিনি গোপনীয়তা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার জন্য পরিচিত, যার অবস্থাগুলো বিটকয়েনের নীতির সাথে খুব সন্দরভাবে মিলে যায়।
২০২৪ সালের অক্টোবরে, চলচ্চিত্র নির্মাতা কুলেন হোব্যাক "মানি ইলেকট্রিক: দ্য বিটকয়েন মিস্ট্রি" শিরোনামে একটি ডকুমেন্টারি ঘোষণা করেন, যেখানে সাতোশির সন্ধানের ইঙ্গিত দেওয়া হয়। এই ডকুমেন্টারিতে বিটকয়েন ডেভেলপার পিটার টডকে সাতোশি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তবে টড এই দাবি অস্বীকার করেছেন।
অন্যান্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন নিক সজাবো, হ্যাল ফিনি এবং অ্যাডাম ব্যাক। এছাড়াও ক্রেগ রাইট দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছিলেন যে তিনি সাতোশি নাকামোটো। তবে ২০২৪ সালের মার্চে একটি ব্রিটিশ আদালত তার দাবি খারিজ করে দেয়।
কে এই সাতোশি নাকামোটো
২০০৯ সালের ৩ জানুয়ারি, "সাতোশি নাকামোটো" নামে একজন ব্যক্তি প্রথম বিটকয়েন মাইন করেন। বিটকয়েনের whitepaper- যা একটি বিকেন্দ্রীকৃত পিয়ার-টু-পিয়ার ইলেকট্রনিক ক্যাশ সিস্টেমের ধারণাকে উপস্থাপন করে ২০০৮ সালের ৩১ অক্টোবর প্রকাশিত হয়।
বিটকয়েন তৈরি করা হয়েছিল ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, যা বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারের তারল্যকে প্রভাবিত করেছিল। বিটকয়েনের লক্ষ্য ছিল একটি বিকেন্দ্রীকৃত আর্থিক ব্যবস্থা তৈরি করা, যেখানে সকল শ্রেণীর ব্যক্তি আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে পারে।
সাতোশি নাকামোটোর সম্ভাব্য পরিচয়
সাতোশি নাকামোটোর প্রকৃত পরিচয় নিয়ে বিভিন্ন অনুমান রয়েছে। কিছু লোক বিশ্বাস করেন যে সাতোশি নাকামোটো একজন ব্যক্তি নন, বরং একদল ক্রিপ্টোগ্রাফার। কেনা বিটকয়েনের সামগ্রিক উন্নয়নে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অবদান রয়েছে। তবে অনেকগুলো উপাদানের ভিত্তিতে কোন কোন বিশেষজ্ঞ একক কিংবা দলগতভাবে নিম্নোক্ত ব্যক্তিদেরকে নাকামটো হিসেবে চিহ্নিত করা প্রয়াস পেয়েছেন:
* ডোরিয়ান নাকামোটো: ২০১৪ সালে নিউজউইক সাতোশি নাকামোটো হিসেবে ডোরিয়ান নাকামোটোকে চিহ্নিত করে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। তবে ডোরিয়ান যেকোনো সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেন।
* নিক সজাবো: ক্রিপ্টো বিশেষজ্ঞ নিক সজাবোও সাতোশি নাকামোটো হিসেবে সন্দেহভাজন ছিলেন। তিনি স্মার্ট কন্ট্রাক্ট এবং বিট গোল্ডের ধারণা প্রবর্তন করেন, যা বিটকয়েনের পূর্বসূরী।
* হ্যাল ফিনি: হ্যাল ফিনি একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী এবং ক্রিপ্টোগ্রাফি উত্সাহী ছিলেন। তিনি সাতোশি নাকামোটোর কাছ থেকে প্রথম বিটকয়েন লেনদেন করার সুযোগ পান।
* লেন সাসামান: লেন সাসামান একজন প্রখ্যাত ক্রিপ্টোগ্রাফার ছিলেন, যার কাজ বিটকয়েনের বিকেন্দ্রীকরণ এবং গোপনীয়তার আদর্শের সাথে মিলে যায়।
* অ্যাডাম ব্যাক: অ্যাডাম ব্যাক বিটকয়েনের মাইনিং প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে হ্যাশক্যাশ তৈরি করেন। তিনি সাতোশি নাকামোটোর সাথে প্রথম যোগাযোগকারী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন।
* পিটার টড: এইচবিওর ডকুমেন্টারিতে পিটার টডকে সাতোশি নাকামোটো হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যদিও টড এই দাবি অস্বীকার করেছেন।
বিটকয়েনে সাতোশি নাকামোটোর গুরুত্ব
বিটকয়েনে সাতোশি নাকামোটো গুরুত্বপূর্ণ কারণ তিনি বিটকয়েন তৈরি করেছিলেন, যা আর্থিক ব্যবস্থায় বিপ্লব এনেছে। বিটকয়েনের মাধ্যমে একটি বিকেন্দ্রীকৃত এবং নিরাপদ আর্থিক ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, যা ঐতিহ্যবাহী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর নির্ভরশীল নয়।
বিটকয়েনের সাফল্য দেখায় যে প্রযুক্তির মাধ্যমে আর্থিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা সম্ভব। এটি শুধুমাত্র একটি মুদ্রা নয়, বরং একটি নতুন অর্থ ব্যবস্থার প্রতীক।
সাতোশি নাকামোটোর রহস্য
সাতোশি নাকামোটোর প্রকৃত পরিচয় এখনও অজানা। তিনি একজন ব্যক্তি নাকি একদল মানুষ, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তার কোডিং দক্ষতা এবং বিটকয়েনের Whitepaper থেকে বোঝা যায় যে তিনি একজন প্রখ্যাত প্রোগ্রামার।
সাতোশি নাকামোটোর পরিচয় গোপন রাখার পিছনে একটি কারণ হতে পারে বিটকয়েনের বিকেন্দ্রীকৃত প্রকৃতি। তার পরিচয় প্রকাশ হলে বিটকয়েনের উপর তার প্রভাব পড়তে পারে, যা বিটকয়েনের মূল উদ্দেশ্যের বিরোধী।
সাতোশি নাকামোটো: সত্য ও রহস্য
মিডিয়ার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সাতোশি নাকামোটোর প্রকৃত পরিচয় এখনও অজানা। তবে পাবলিক রেকর্ড বা দক্ষ অনুসন্ধানের মাধ্যমে আমরা সাতোশি সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে পারি। যেমন:
ক) সাতোশি নাকামোটো একজন কোডিং জিনিয়াস- দ্য নিউইয়র্কার সাতোশিকে "অসাধারণ প্রতিভাধর কম্পিউটার কোডার" বলে উল্লেখ করেছে, যিনি ৩১,০০০ লাইনের কোড দিয়ে বিটকয়েন তৈরি করেছেন। বিটকয়েনের কোড প্রায় নিখুঁত, যা এটিকে সুরক্ষিত এবং হ্যাকারদের জন্য প্রবেশের অযোগ্য করে তুলেছে। ২০১১ সালে ইন্টারনেট সিকিউরিটি গবেষক ড্যান কামিনস্কি বিটকয়েনের কোড ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ব্যর্থ হন।
খ) সাতোশি নাকামোটো ব্রিটিশ ইংরেজিতে অনেক বেশি দক্ষ- সাতোশির কোড এবং বিটকয়েনের Whitepaper থেকে বোঝা যায় যে তিনি ব্রিটিশ ইংরেজিতে দক্ষ। এটি কিছু লোককে বিশ্বাস করতে পরিচালিত করেছে যে সাতোশি ব্রিটিশ হতে পারেন, যদিও তিনি নিজেকে জাপানি বলে দাবি করেছেন।
গ) সাতোশি নাকামোটো একাধিক ব্যক্তি হতে পারেন- কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে সাতোশি একজন মাত্র ব্যক্তি নন, বরং একদল ব্যক্তি যারা বিটকয়েনের কোড তৈরি করেছেন। বিটকয়েন ডেভেলপার লাসজলো হ্যানিয়েকজের মতে, বিটকয়েনের কোড তৈরি করার জন্য একাধিক ব্যক্তির প্রয়োজন ছিল।
ঘ) সাতোশি নাকামোটোর লিঙ্গ নিয়ে অনিশ্চয়তা- সাতোশি নাকামোটো পুরুষ নাকি মহিলা, তা নিয়ে কোনও নিশ্চিত তথ্য নেই। প্রযুক্তি শিল্পে পুরুষদের আধিপত্যের কারণে একজন মহিলা পুরুষ নাম ব্যবহার করে সমান মর্যাদা পেতে পারেন। নিউইয়র্কের কংগ্রেস ওম্যান ক্যারোলিন ম্যালোনি "সাতোশি একজন মহিলা" ট্যাগ লাইনটি জনপ্রিয় করেছেন।
সাতোশি নাকামোটোর পরিচয় এখনও রহস্যে আবৃত, তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় তার তৈরি বিটকয়েন আর্থিক ব্যবস্থায় বিপ্লব এনেছে।
বিটকয়েনের ভবিষ্যৎ
বিটকয়েনের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। এটি শুধুমাত্র একটি মুদ্রা নয়, বরং একটি নতুন অর্থব্যবস্থার প্রতীক। বিটকয়েনের মাধ্যমে ব্যক্তিরা তাদের আর্থিক লেনদেনের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। বিটকয়েনের সাফল্য দেখায় যে প্রযুক্তির মাধ্যমে আর্থিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা সম্ভব।
শেষ কথা
সাতোশি নাকামোটোর পরিচয় এখনও রহস্যে আবৃত। তিনিএকজন ব্যক্তি নাকি একদল মানুষ, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে তার তৈরি বিটকয়েন আর্থিক ব্যবস্থায় বিপ্লব এনেছে এবং ভবিষ্যতেও এর প্রভাব থাকবে। যদিও এইচবিওর ডকুমেন্টারি সাতোশি নাকামোটোর পরিচয় নিয়ে বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে, তবে কোনও জোড়ালো প্রমাণ ছাড়াই বিটকয়েনের স্রষ্টার প্রকৃত পরিচয় রহস্যেই থেকে যাবে। অনেকের মতে, এটি এমনই থাকা উচিত। সাতোশির গোপনীয়তা বিটকয়েনের বিকেন্দ্রীকরণের আদর্শের জন্য অপরিহার্য, যা নিশ্চিত করে যে কোনও একক ব্যক্তি এর ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বিটকয়েন যতই বিকশিত হোক না কেন, এর মূল্য এর স্রষ্টার পরিচয়ের মধ্যে নয়, বরং এটি কিভাবে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি এবং প্রযুক্তিকে পুনর্গঠিত করেছে তার মধ্যে নিহিত।
X
Very Good
Good
thanks
OK